Header Ads

আতঙ্কের জলাতঙ্ক

জলাতঙ্ক 

জলাতঙ্ক একটি রোগের নাম।একে ইংরেজিতে Rabies(রেবিজ) বলা হয়।এটি ভাইরাস জনিত একধরনের জুনোটিক রোগ। (যে রোগ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় তাকে জুনোটিক রোগ বলে।) রেবিজ ভাইরাস নামক এক ধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস দ্বারা জলাতঙ্ক হয়। এই রোগ সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী ও বন্য প্রাণীদের প্রথমে সংক্রমিত করে, মানুষ এই প্রাণী গুলির বা এদের লালার সংস্পর্শে আসলে বা এই প্রাণীগুলি যদি মানুষকে কামড়ায় অথবা আচুড় দেয় তাহলে এই রোগ মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। জলাতঙ্ক রোগ এন্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই দেখা গেছে। জলাতঙ্ক রোগের জন্য প্রতি বছর বিশ্বে চব্বিশ থেকে ষাট হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে।


ট্রান্সমিশন মাইক্রোগ্রাফ চিত্রে অসংখ্য রেবিজ ভিরিয়ন (গাঢ় ধূসর বর্ণের কণিকাসমূহ) ও নেগ্রিবডি (রেবিজ ইনফেকশনের সেলুলার ইনক্লুশন) দেখা যাচ্ছে



জলাতঙ্কের উপসর্গ
রেবিজ ভাইরাসের সুপ্তাবস্থা কামড়ের স্থানের উপর ভিত্তি করে দুই থেকে ষোল সপ্তাহ বা আরো বেশি হতে পারে।পায়ের তুলনায় মাথার দিকে কামড়ালে সুপ্তিকাল আরো কমে যায় কারণ ভাইরাসের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছাতে কম সময় লাগে। প্রথম দিকে অনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ যেমন- জ্বর, ক্ষুধামন্দা, কামড় স্থানের অনুভুতিতে পরিবর্তন যেমন- চিনচিন, ঝিনঝিন ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। কয়েকদিন পর থেকে তন্দ্রা, কনফিউশন, অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা, লালা রসের ক্ষরণ বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে ঢোক গিলার সময় ডায়াফ্রাম, রেসপিরেটোরি মাসল ও কণ্ঠনালীর তীব্র ব্যথাযুক্ত সংকোচন হয়। বিশেষ করে পানি পান করার চেষ্টা করলে ডায়াফ্রাম ও অন্যান্য ইন্সপিরেটোরি মাসলের তীব্র সংকোচন ও ব্যথা হয় ফলে রোগীর মধ্যে হাইড্রোফোবিয়া বা পানি ভীতি তৈরী হয়। এই অবস্থার জন্যই বাংলায় এই রোগকে জলাতঙ্ক নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়া রোগীর ডিলিউসন, হ্যালুচিনেশন ও পাগলামি, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়ানোর অক্ষমতা, চেতনাশূন্যতা দেখা যায়।

রেবিজ ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি
রেবিজ ভাইরাস কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি প্রাণীর কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। কামড়ের স্থানেই এরা বংশবৃদ্ধি আরম্ভ করে দেয়। এরা সংবেদি স্নায়ুকে আক্রান্ত করে এবং অ্যাক্সন বেয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের দিকে এগোতে থাকে। স্নায়ুর মধ্য দিয়ে পরিবহনের সময় সাধারণত কোনো ইমিউন রিয়্যাকশন হয় না, যদিও বা হয় তাহলে তা খুব সামান্য। ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছানোর পর সেখানে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং পুনরায় প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র বেয়ে লালা গ্রন্থিসহ অন্যান্য অঙ্গে এসে জমা হয়। লালাগ্রন্থি থেকে লালা রসে ভাইরাস প্রবেশ করে ফলে জলাতঙ্ক রোগীর কামড়ের মাধ্যমে এটা অন্যের দেহে পরিবাহিত হতে পারে। স্নায়ুতন্ত্রে এটি নিউরনকে ধ্বংস করে এবং এনসেফালাইটিস করতে পারে।
 
রেবিজ ভাইরাস
রেবিজ বা জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার

1885 সালের জুলাই মাসের চার তারিখ ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে নয় বছরের বাচ্চা ছেলে জোসেফ মাইস্টার স্কুলে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাচ্চাটিকে আঁচড়ে-কামড়ে শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি করে দিল। এই পাগলা কুকুরটা ভয়ংকর রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে ভুগছে। যেভাবে কুকুরটা বাচ্চাটিকে কামড় দিয়েছে তাতে বাচ্চাটিও যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 1885 সালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা ছিল না। এটি যে একটি ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও কেউ জানতো না। এখনকার মানুষ যেমন জানে, তখনকার মানুষও তেমনি জানতো রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কের রোগের মৃত্যু থেকে ভয়ংকর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। জ্বর দিয়ে শুরু হয়, অস্বাভাবিক একধরনের বিষণ্নতা ভর করে সেটা পাল্টে যায় অনিয়ন্ত্রিত একধরনের উত্তেজনায়। গলার মাংসপেশীতে এক ধরনের খিঁচুনী শুরু হয়। মুখ থেকে ফেনা বের হতে শুরু করে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু একবিন্দু পানি খেলেই খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। শেষের দিকে পানি খেতে হয় না। পানি দেখলেই উন্মত্ত এক ধরনের খিঁচুনি ভর করে। জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে বললেন, তার কিছুই করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্যারিসের লুই পাস্তুরের কাছে নেওয়া যেতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়নবিদ। তার বয়স তখন তেষট্টি, স্টোকে শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তার ক্ষমতার উপর অগাধ বিশ্বাস। লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়েই মাইক্রোবায়োলজি বা আধুনিক চিকিৎবিজ্ঞান শুরু হয়েছে।1880 সালে যখন লুই পাস্তুর তার অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন তখন এটি সম্পর্কে তিনটি বিষয় জানা ছিল। এক. রেবিজ আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে। দুই. পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরী হলে এই রোগের সংক্রমণ হয়। এবং তিন. সংক্রমণের পর কয়েকদিন থেকে কয়েকসপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলি দেখা যায়। এর বাইরে পুরোটাই রহস্য লুইপাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গেলে তার রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে রেবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তাছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত একটা পদ্ধতি বের করতে হবে। লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুরোগ, মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ আছে।জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং লুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে দ্রুত তিনি পশুকে রেবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পেরেছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন; রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা। এখানে এসে তিনি যেন এক শক্ত পাথরের দেয়ালের মাঝে ধাক্কা খেলেন। কিছুতেই এই অদৃশ্য কারণকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটা ব্যাক্টেরিয়াকে কৃত্রিম পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বংশবৃদ্ধি বা কালচার করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য পরজীবী প্রাণটিকে কোনো ভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। লুই পাস্তুর আবার খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো ভাবলেন যদি তাকে কৃত্রিম অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না-ই যায়, তাহলে তাকে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখা হোক। সেই জীবন্ত অংশটুকু হলো খরগোশের মস্তিষ্ক। আবার লুই পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচেই থাকে না, আরো ভয়ংকর আরও সর্বনাশী হয়ে ওঠে, ছয়দিনের মাঝে এই রোগ তার সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়। লুই পাস্তুর এখন গবেষণার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন, এখন এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হবে যেটা দিয়ে এই রোগের প্রতিষেধক বের করা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দেখলেন একজন সহকারী জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটা খরগোশের স্পাইনাল কর্ড কাচের ফ্লাস্কে ঝুলিয়ে রেখেছেন, কতদিন এই ভয়ংকর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে সেটাই হচ্ছে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লুই পাস্তুর কাচের ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, কিছুদিন আগেই মোরগের কলেরা রোগের ব্যাক্টেরিয়াকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখানেও সেটি কি করা যায় না? যে অদৃশ্য জীবাণু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই সেটাকে কী দুর্বল করে এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবহারিক বিজ্ঞানী তখন কাজে লেগে গেলেন। খরগোশের স্পাইনাল কর্ডে বেঁচে থাকা জীবাণুকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করতে লাগলেন। প্রতিদিন সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে সেটাকে গুঁড়ো করে সুস্থ খরগোশের মাথায় ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। যতই দিন যেতে লাগলো এই ভয়ংকর জীবাণু ততই দুর্বল হতে শুরু করলো, বারো দিন পর জীবাণু এত দুর্বল হয়ে গেল যে, সেটা সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেই পারলো না। এখন আসল পরীক্ষাটি বাকি, এই প্রক্রিয়ায় সত্যিই কি জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরী করা সম্ভব? লুই পাস্তুর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। একটা কুকুরের মস্তিষ্কে প্রথমে বারো দিনের দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হলো, তার পরের দিন এগারো দিনের জীবাণু তার পরেরদিন দশ দিনের জীবাণু।


এভাবে প্রত্যেক দিনই আগের থেকে একটু বেশি ভয়ংকর জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেওয়া হলো কিন্তু এত দিনে কুকুরটির দেহে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরী হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর নিয়েও সেটি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলো। লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন তবে মানুষের জন্য নয় পশুর জন্যে। ঠিক এরকম সময়ে নয় বছরের জোসেফ মাইস্টারকে নিয়ে তার মা এলেন লুই পাস্তুরের কাছে, আকুল হয়ে লুই পাস্তুরকে বললেন, তার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। লুই পাস্তুর খুব চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, নয় বছরের এই বাচ্চার মাঝে নিশ্চিতভাবেই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু ঢুকে গেছে, একজনের শরীরে জীবাণু ঢোকার পর তার শরীরে কী প্রতিষেধক তৈরী করা যাবে? যে প্রক্রিয়া কখনো কোনো মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয়নি সেটি কি একটা শিশুর শরীরে পরীক্ষা করা যায়? অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দুই সপ্তাহের পুরোনো জীবাণু তারপর তেরো দিনের তারপর বারো দিনের। এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো ততই আগ্রাসী জীবাণু বাচ্চাটির শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। একে বারে শেষদিন তার শরীরে জলাতঙ্ক রোগের যে জীবাণু ঢোকানো হলো সেটি অন্য যে কোনো পশু বা মানুষকে এক সপ্তাহের মধ্যে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে। সেই সময়টা সম্ভবত ছিল লুই পাস্তুরের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় -- তিনি খেতে পারেন না, ঘুমাতেও পারেন না, তার মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছেলেটি কি বাঁচবে না মারা যাবে? ছেলেটি মারা যায়নি। লুই পাস্তুরেরর চিকিৎসায় প্রথম জলাতঙ্ক রোগীটি বেঁচে উঠলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় অবদানটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

রোগের শনাক্তকরণ
সাধারণত জলাতঙ্ক রোগের ইতিহাস ও উপসর্গের উপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। তবে কর্নিয়াল ইম্প্রেশন স্মিয়ার ও স্কিন বায়োপসি থেকে রেপিড ইমিউনোফ্লুরেসেন্ট টেকনিকের মাধ্যমে অ্যান্টিজেন শনাক্ত করা সম্ভব।

রেবিজ ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর


 চিকিৎসা 
এই রোগ একবার হলে মৃত্যু অনিবার্য। সাধারণত লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগী মৃত্যু বরণ করে। কোনো অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। শুধু উপশমমূলক চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এই রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। রেবিড প্রাণী (রেবিজ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত প্রাণীকেই রেবিড প্রাণী বলা হয়) কামড় দেওয়ার সাথে সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকা নিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রতিরোধ
এই রোগ প্রতিরোধের উপায় হলো টিকা নেওয়া। এই ভাইরাসের অনেক রকম টিকা আবিষ্কার হয়েছে তবে সবচেয়ে নিরাপদ টিকা হলো হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিন (HDCV)। অন্যান্য টিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পিউরিফাইড চিক ইমব্রিও সেল ভ্যাকসিন, ডাক ইমব্রিও সেল ভ্যাকসিন, নার্ভ টিস্যু ভ্যাকসিন ইত্যাদি। ডাক সেল ভ্যাকসিনের ইমিউনোজেনেসিটি বা কার্যকারিতা কম এবং নার্ভ টিস্যু ভ্যাকসিন অ্যালার্জিক এন সেফালোমায়েলাইটিস করতে পারে। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে টিকা নেওয়াকে প্রি-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস ও আক্রান্ত হওয়ার পর টিকা নেওয়াকে পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস বলে।
 প্রি-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস
পশু চিকিৎসক, চিড়িয়াখানার প্রাণীদের দেখাশোনাকারী, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী লোকজন বা উক্ত এলাকায় ভ্রমণকারী ব্যক্তি ও যারা বাড়িতে কুকুর পোষে তাদেরকে প্রতিরোধমূলক টিকা দেওয়া হয়। সাধারণত তিনটি ডোজ ০,৭ ও ২১ বা ২৮ তম দিনে ও প্রতিবছর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস
রেবিজ ভাইরাসের সুপ্তাবস্থা অনেক বেশি হওয়ায় টিকা দেওয়ার পরে প্রতিরোধ বা ইমিউনিটি তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে তাই এই ভ্যাকসিন পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস হিসেবে নিয়মিত রুটিন-মাফিক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার দশ দিনের মধ্যে দিলেও ক্সজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষত স্থানটি সাবান ও পানি দিয়ে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধৌত করতে হবে অতঃপর আয়োডিন দ্রবণ দিয়ে পুনরায় পরিষ্কার করতে হবে। টিটেনাস টিকাও দেবার কথা বিবেচনা করতে হবে। পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিসের মধ্যে টিকা ও হিউম্যান রেবিজ ইমিউনোগ্লোবিউলিন (RIG) উভয়ই অন্তভূর্ক্ত। হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিনের পাঁচটি ডোজ ০, ৩, ৭, ১৪ ও ২৮ তম দিনে দেওয়া হয়। তবে ৯০ তম দিনে আরেকটি বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে। RIG শুধু একবার প্রথমদিনে দেওয়া হয়। এটি মূলত ক্ষতস্থানে বেশি দিতে হয়, বাকি অংশটুকু মাংসপেশিতে দিতে হয়। টিকার মধ্যে নিষ্ক্রিয় রেবিজ ভাইরাস থাকে পক্ষান্তরে ইমিউনোগ্লোবিউলিন হলো অ্যান্টিবডি তাই এই দুটি ইনজেকশন শরীরের দুটি ভিন্ন জায়গায় পর্যাপ্ত দুরত্ব বজায় রেখে দিতে হয় নতুবা RIG মধ্যস্থিত অ্যান্টিবডি ভাইরাসটিকে অকেজো করে দিবে এবং টিকার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। যদি কামড় প্রদানকারী প্রাণীকে ধরে ফেলা যায় তাহলে ১০ দিন তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যদি প্রাণীটির মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে তাকে মেরে ফেলা উচিত।

পরিশেষে
প্রতিবছর বিশ্বে যত মানুষ কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার ৯৯ শতাংশই জলাতঙ্ক রোগের কারণে হয়। এই রোগে এখন আর কোনো ভয় নেই। সময় মতো ও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে টিকা প্রদানের মাধ্যমে বা আগাম টিকা প্রদান করে আগে থেকেই এই রোগকে প্রতিরোধ করা যায়। প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় "বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস"। অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল "এলায়েন্স ফর রেবিজ কন্টোল" তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দফতর থেকে এ দিবস পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়ের ভুমিকা পালন করে। এই দিনটিতে সারা বিশ্বে জলাতঙ্কের ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ বিষয়ক সেমিনার ও আলোচনার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে তোলা হয়।

 লেখাটা সংগ্রহ করেছি উইকিপিডিয়া ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা "একটুখানি বিজ্ঞান" বই থেকে।

Department of Botany
Govt. Bangla College


No comments

Powered by Blogger.